৩৬ তম জন্মদিনটা অনেকদিক থেকেই মেসির জন্য আলাদা।
এর আগের জন্মদিনগুলোতে তাঁর সর্বকালের সেরার পাশে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিলো। বাট এবারের জন্মদিনে সেখানে আর প্রশ্নবোধক চিহ্নটা নাই, বরং ওখানে একটা ফুলস্টপ পড়ে গেসে।
কাতার বিশ্বকাপ জেতার মধ্যে দিয়ে তিনি টেনে দিয়েছেন এই বিতর্কের চূড়ান্ত সমাধান। সেই হিসেবে এই জন্মদিনটা মেসির জন্য স্পেশাল।
কিশোর বয়সে না, মেসি আর্জেন্টিনা ছেড়েছিলেন বালক বয়সে।
বার্সেলোনার লা মেসিয়াহতে টিস্যু পেপারের উপর চুক্তির মাধ্যমে সেই যে মেসির ইউরোপে খেলা শুরু হলো, এই জন্মদিনে সেইটার একটা সমাপ্তিও মেসি টেনে ফেললেন।
ইউরোপের গতিশীল ফুটবলের প্রেশার থেকে নিজেকে মুক্ত করে তিনি চলে গেলেন ইউএসএতে। বলা চলে, এর মাধ্যমে মেসি শুরু করলেন নিজেকে পেশাদার ফুটবল থেকে সরিয়ে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক যাত্রাও।
সেদিক থেকেও মেসির জন্য এই জন্মদিনটা স্পেশাল।
কিন্তু এই ৩৬ বছর বয়সে মেসির সেরা ট্রান্সফর্মেশন কোনটা ছিলো? বার্সেলোনার মেসি থেকে আর্জেন্টিনার মেসি হয়ে উঠা? শূন্য হাত থেকে পূর্ণ হাত নিয়ে জাতীয় দলের মেসি হয়ে উঠা? নাকি ইউরোপ থেকে ফুটবলের পার্ট চুকিয়ে আমেরিকান সকারে চলে আসা?
আমার মনে হয়, উপরের একটাও আসলে মেসির সেরা ট্রান্সফরমেশন ছিলো না।
বরং ৩৬ বসন্তে এসে মেসির সবচে সেরা পরিবর্তনটা ছিলো, শান্তিপ্রিয়, কারো সাতেপাচে না থাকা নিরীহ একজন ফুটবলার থেকে ক্রমশ একজন পূর্ণাঙ্গ নেতা হয়ে উঠা।
হ্যা, আজকে আমি প্লেয়ার মেসিকে না, মানুষ মেসিকেও না, আজকে আমি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চাই, এই নেতা মেসিকে। যেই মেসি নেদারল্যান্ডস এর বিরুদ্ধে হলুদ কার্ড দেখার পরেও লুই ফন গালের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন, এমনকি ম্যাচের পরেও নেদারল্যান্ডসকে করেছেন প্রকাশ্যে গালিগালাজ।
এই মেসিকে আমরা আগে চিনতাম না। মেসি নিজেও কি এই নিজেকে আগে চিনতেন? সম্ভবত না।
২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলে সবচে অ্যাগ্রেসিভ মানুষটার নাম ছিলো, দলের কোচ ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এর বাইরে আর্জেন্টিনা দলে গ্যাঞ্জাম করার কোন প্লেয়ার ছিলো না। ইন্ট্রোভার্ট, জলের মতো শান্ত একজন খেলোয়াড় হিসেবে মেসি উপস্থিত ছিলেন। বল পায়ে যিনি বাঘের মতো ক্ষিপ্র, বাট বল পায়ে না থাকলে আবার পানির মতোই শান্ত।
এই শান্তিপ্রিয়, ইন্ট্রোভার্ট মেসিকে আমরা ২০১৪ তেও দেখেছি। নেদারল্যান্ডসের সাথে ঐ ম্যাচেও পরিবেশ বেশ গরম ই ছিলো। বাট মেসি ঐ ম্যাচেও নিজেকে এইসব থেকে দূরে রেখেছিলেন। ২০১৬ পর্যন্ত বল আর খেলার বাইরে মেসিকে আমি মাঠে খুব বেশি এক্টিভ থাকতে দেখিনি।
২০১৬ সালের অবসর ভেঙে ফিরে আসা মেসির মধ্যে হঠাৎ করেই আমরা ধীরে ধীরে অ্যারোগেন্ট এবং ড্যাম কেয়ার একটা ভাব চলে আসতে দেখলাম। নেতা মেসির দিন বদলের শুরু মূলত এখান থেকেই হয়েছিলো।
২০১৬ র কোপার ফাইনালে হেরে যে মেসি কান্নায় ভেঙে পড়ে জাতীয় দলরে বিদায় বলে দিলেন, ২০১৮ র বিশ্বকাপে সেকেন্ড রাউন্ডে হারার পর মেসির প্রতিক্রিয়া ছিলো, চেষ্টা করেছি। হয় নাই। এখন আমাদের সামনে তাকাতে হবে।
হেরে যাওয়ার পরেও মেসির সেদিনের সেই কনফিডেন্স এর পেছনে ছিলো তাঁর এই নেতৃত্ব, নতুন দিনের ক্যান্টেন্সি।
খেয়াল করলে দেখবেন, ২০১৯ থেকে আর্জেন্টিনা গা জোয়ারি ফুটবলও শুরু করে। যেই আর্জেন্টিনা ফেয়ার প্লেতে অভ্যস্ত ছিলো, মেসির নেতৃত্বে সেই আর্জেন্টিনা তখন প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষের চে বেশি ফাউল করা শুরু করেছে, এমনকি বেশি কার্ড খাওয়া পর্যন্ত শুরু করেছে।
এবং এসব কিছুই হয়েছে মেসির নীরব প্রশ্রয়ে।
এমনকি ব্রাজিল ম্যাচে হুট করে মেসি নিজের সিদ্ধান্তে না খেলে দল নিয়ে বের হয়ে আসলেন। রেফারির সাথে করলেন তুমুল তর্কত । সাফ জানিয়ে দিলেন, তার দলের চারজন প্লেয়ারকে খেলতে না দিলে তিনিও খেলবেন না। ওয়াক আউট করবেন।সত্যিই তিনি তাই করলেন
বলাই বাহুল্য, এই কাজের পর মেসির গুড বয় বা ইন্ট্রোভার্ট ভালো মানুষের ইমেজ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। বাট, এর বদলে মেসি পেয়েছিলেন, ভালোবাসা।
আর্জেন্টিনার প্রতিটা প্লেয়ার এতোদিন খেলেছে আর্জেন্টিনার জন্য, এবার তারা তাদের নেতা মেসির জন্য খেলা শুরু করলো।
এই যে এমি মার্টিনেজ বলেছিলেন, মেসির জন্য আমি আমার জীবন দিয়া দিতে পারি, এমন কথা শুধু ভালো খেলোয়াড়দের জন্য কেউ বলে না। এমন কথা মানুষ বলে নেতাদের জন্য, মেসি যেই নেতৃত্বের আসনটা ২০২০ এ আইসা পাইসিলেন, এর আগে পাননি।
এরই ধারাবাহিকতাতেই মূলত ডি পল বা অ্যালিস্টারদের মতো তরুণরা এতোটা আগ্রাসী হয়ে খেলতে পেরেছিলেন। ২০২০ এর অ্যারোগেন্ট মেসি যদি ২০১০ এর সেই ইন্ট্রোভার্ট মেসি হতেন, তাহলে কি আমরা এমন মারমুখী আর্জেন্টিনার দেখা পাইতাম? সম্ভবত পাইতাম না।
একজন নেতা ঠিক এভাবেই দলরে পাল্টাইয়া দেন। ম্যারাডোনা পাল্টাইছিলেন ১৯৮৬ তে। জিদান পাল্টাইসিলেন ১৯৯৮ তে, আর মেসি আইসা পাল্টাইলেন ২০২২ এ।
২০১০, ১৪ আর ১৮ তে নিজের ফুটবলীয় দক্ষতায় সেরা হয়েও মেসি যে কাপ জিততে পারলেন না, ২২ এ এসে সেই বিশ্বকাপ তিনি জিতলেন নেতা হয়ে। কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলার মেসির সাথে সাথে ছিলো নেতা মেসিরও নেতৃত্ব প্রদর্শনের একটা মঞ্চ, এই কথা তাই জোর দিয়েই বলা যায়।
মেসির জন্মদিনে ফুটবলার মেসিকে নিয়ে কম প্যারাগ্রাফ লেখা হয় নাই। আমি নিজেও অনেক লিখেছি। জাদুকরি ফুটবলের কথা লিখেছি, অসাধারণ মনুষ্যত্বের কথা লিখেছি, সবুজের ক্যানভাসে শিল্পের কথা লিখেছি।
বাট এই যে একজন ইন্ট্রোভার্ট, চুপচাপ, শান্ত মানুষটা আজ ১২ বছর পর আইসা এমন অ্যারোগেন্ট, প্রতিবাদী এবং আগ্রাসী হয়ে গেলেন, একটা মিডিওকোর দলরে আর্মির মতো একটা সুতোয় বেঁধে চ্যাম্পিয়ন করলেন, মাঠের খেলা বা মাঠের বাইরের আগ্রাসনেও নেতৃত্ব দিলেন সামনে থেকে, এই কথা আমরা কী করে ভুলে যাবো?
ফুটবলার মেসি, জাদুকর মেসির পাশাপাশি আমি তাই ৩৬ তম বয়সী নেতা মেসিকেও জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
শান্তিপ্রিয় একজন গুড বয় থেকে কীভাবে সময়ের প্রয়োজনে একজন দুধর্ষ কমরেড হতে হয়, কীভাবে সামনে থেকে দেশের নেতৃত্ব দিতে হয়, সেটা কমরেড মেসির চে ভালো করে আর কে দেখাতে পেরেছেন?
মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কথাটা সাধারণত ইউজ করা হয় নেগেটিভ অর্থে।
বাট বাট কখনও কখনও একজন মানুষের বদলে যাওয়াও যে কতটা অসহ্য সুন্দর হতে পারে, সেটা মেসি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইয়া দিয়ে গেলেন।
হ্যাপি বার্থডে লিও ।
তুমি আমাদের সময়ে অসময়ে যতটা আনন্দ আর হাসির কারণ হয়েছে, সেই আনন্দকে বহুগুন করে খোদা যেন তোমার কাছে ফেরত দেয়, আজকে তোমার জন্য আমার এই প্রার্থনাটুকু থাকলো।
ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্নস অব দ্য ডে!!
সাদিকুর রহমান খান
রাজশাহী
ভাইয়া আপনাকে ফেইসবুকে কেনো পাচ্ছিনা?🙂
🫂